মো:সামছুল আলম
বর্তমান সরকারের সময়ে নগদ টাকায় সচিব হয়, এটা কোনো বাজে কথা নয়। চ্যালেঞ্জ করবেন না। এর প্রমাণ আমি নিজেই জানি। ছোট ছোট করে কয়েকটা ঘটনা বলি:
ঘটনা-এক
আমাকে যখন কেবিনেটে বসা আটকে দেয়া হলো, (গত ডিসেম্বরে ড. রশিদের দুদক চেয়ারম্যান, এবং আমার কেবিনেট সচিব হওয়া নির্ধারিত ছিল, প্রধান উপদেষ্টা আমার একটি নথিও সাক্ষর করেছেন), তখন একটা গ্রুপ আমাকে ফোন করেছিল, “স্যার আপনাকে কেবিনেটে বসিয়ে দেই, আমরা শত কোটি টাকা খরচা করবো, আপনি শুধু হ্যাঁ বলুন”। আমি বলেছি, “না। আমি ওই লাইনের লোক না। কিছু না হলেও আমি দুর্নীতির সাথে আপোষ করবো না!”
ঘটনা-দুই
আমি একদিন বসে আছি এক অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি রুমে, তিনি আমার ৬ ব্যাচ জুনিয়র। কথা বলছি। হঠাৎ করে আমাকে বলেই উঠে গেলেন। কোথায় গেল বুঝতে পারিনি। তবে পরে বুঝলাম আমার পেছন দিকে সোফায় বসে কথা বলে এসেছেন খুব নিরবে। আমি শুনতে পাইনি কিছুই। সিটে এসে আমাকে বললেন, “স্যার, ক্ষমা করবেন। দু’জন সমন্বয়ক এসেছিলেন, তাই কথা বললাম।” আরও বলল, “আমার সাথে চুক্তি করতে এসেছিল, আমাকে জ্বালানি সচিব করতে চায় মোটা টাকার অফারে। আমার একটা কালার পিডিএস দিতে হবে, একটা চুক্তিপত্রে সই করতে হবে, আর আমার ন্যাশনাল আইডি কার্ডের কপি দিতে হবে।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি দিয়েছো?” বলল, “না স্যার, আমি দেইনি।” এরপর তার ফোন থেকে আরেকজনের স্যাম্পল দলিলের কপি দেখালো। “স্যার, এই যে দেখেন, একজনকে তারা ওইভাবে চুক্তি করে এক মন্ত্রনালয়ে সচিব করেছে। এইরকম চুক্তি করতে হতো। আমার চাকরি অনেক দিন আছে, আমি এই কাজে যাব না, স্যার”। আমি তাকে সাবাসি দিলাম। এখনও ওই অফিসারটি সচিব হতে পারে নি।
ঘটনা-তিন
মে মাসের ৩০ তারিখে আমার এক নির্ভরযোগ্য লোক একটা দলিল পাঠায়, সেটা বর্তমান বানিজ্য সচিব মাহবুবের ৩৫ কোটি টাকার চুক্তির দলিল। এতদিন এটা থামিয়ে রেখেছিলাম, দেখি ভেরিফিকেশন হোক। ভেরিফাই হয়ে এখন নিউজে পরিণত হয়েছে, তারপর আরো কিছু আসছে এগুলো নিউজ পেপারে।
ঘটনা-চার
১৩ ব্যাচের একজন অফিসার মাত্র তিন মাস সচিবগিরি করে উইড্র হয়ে ওএসডি অবস্থায় আছেন। বছরখানেক চাকরিও আছে। ওকে নিয়ে দুটি আলাদা সোর্স জানতে চায়, এই অফিসারটা কেমন। একটা প্রস্তাবে ৩০ কোটি, আরেকটা প্রস্তাবে ৩৬ কোটি- সচিব করার অফার আছে।
ঘটনা-পাঁচ
এর মাঝখানে, এক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফোন করলেন আমাকে সকাল সাড়ে ন’টার দিকে। তিনি আমাকে জানতে চাইলেন তার সচিব সম্পর্কে। কাস্টমস ক্যাডারের অফিসার, নতুন প্রমোশন পেয়ে সচিব হয়েছেন বিস্ময়কর ভাবে। তিনি জানতে পেরেছেন, এই সচিব ৩৫ কোটি টাকায় চুক্তিবদ্ধ হয়ে এখানে এসেছেন। একজন চরম দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা, ঢাকায় পাঁচটা বাড়ি আছে, ওনার অস্ট্রেলিয়ান সিটিজেনশিপ আছে, পরিবার থাকে সেখানে। উনি আসলে যাবেন এনবিআরে, এবং সেখানকার জন্য কয়েক’শো কোটি টাকার ডিল রেডি আছে।
ঘটনা-ছয়
একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিদপ্তরের ডিজি হিসেবে নিযুক্ত আছেন এরকম পনেরো ব্যাচের এক অফিসারের জন্য ৩০ কোটি টাকার অফার আছে। দুর্যোগ সচিব করা হবে। ওই অধিদপ্তরের এডভাইজার মহোদয়কে আমি আজকে জানিয়েছি যে, আপনার ডিজি সচিব হয়ে চলে যাচ্ছে।
ঘটনা-সাত
স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব করা হয়েছে ১০০ কোটি টাকার চুক্তিতে এবং আড়াই কোটি টাকা ক্যাশ দিয়ে। তারপরও চার মাসের বেশি থাকতে পারেনি, এটা এখন সচিবালয়ের সবাই জানে।
ঘটনা-আট
গেলো বছর শেষের দিকে শিপিং মিনিস্ট্রির সচিব বানাতে একজন অফিসারকে অফার দিয়েছিল একজন রিটায়ার্ড লেফটেনেন্ট জেনারেল এবং আলাদাভাবে এডিশনাল সেক্রেটারি এপিডি। ১২ কোটি টাকার ডিল। যারা টাকা খর্চা করবে, তারা পরে তুলে নিবে। কেবল সহযোগিতা করলেই চলবে। অফিসারটি রাজী হননি। পরে অবশ্য তিনি টাকা ছাড়াই সচিব হয়েছেন, এখনও আছেন দুর্বল জায়গায়। সংশ্লিষ্ট অফিসার নিজেই আমাকে ঘটনাটি জানিয়েছিলেন।
আর কয়টা বলব? কাজেই এই সরকারের সময়ে টাকা দিয়ে, অর্থাৎ কোটি কোটি টাকা দিয়ে সচিব হয়, এটা কোনো মিথ্যা কথা নয়। সত্য কথা। সম্পূর্ণ সত্য কথা।
এভাবে একটা দেশ চলতে পারে না
তথ্যসূত্র: নিজস্ব পেজ বুক প্রোফাইল।
লেখক: একজন বুদ্ধিজীবী ও অব:প্রাপ্ত সরকারি আমলা।
সাবেক এপিএস বেগম খালেদা জিয়া।