জনতার দেশ রিপোর্টঃ
পার্বত্য চট্টগ্রামের আলোচিত সশস্ত্র সংগঠন ইউপিডিএফ (প্রসীত বিকাশ খীসা গ্রুপ)-এর নেতা মাইকেল চাকমা চাঁদাবাজির মামলায় আট বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন, যা পাহাড়জুড়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বহু বছর ধরে পাহাড়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, হত্যা, অপহরণ ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে যিনি পরিচিত ছিলেন, সেই মাইকেল চাকমা এখন আইনগত বিচারের মুখোমুখি। যদিও তিনি এসব অভিযোগকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে দাবি করছেন, স্থানীয়দের মতে তিনি পাহাড়ে সহিংস রাজনীতির অন্যতম কারিগর এবং অস্থিতিশীলতার স্থপতি। তার সাজা শুধু একটি ব্যক্তির বিচার নয়, বরং পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা অস্থিরতা, বিভাজন এবং অস্ত্রনির্ভর রাজনীতির বিরুদ্ধে এক নতুন বার্তা বহন করছে।
২০০৭ সালে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অস্ত্র, নগদ টাকা ও চাঁদাবাজির প্রমাণসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই মাইকেল চাকমার নাম পাহাড়ে অপরাধচক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় অন্তত ১১টি মামলা রয়েছে যার মধ্যে হত্যা, অস্ত্র, মাদক, চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণের অভিযোগ উল্লেখযোগ্য। লংগদুর সাম্প্রতিক মামলায় তার বিরুদ্ধে আদালতের দেওয়া আট বছরের কারাদণ্ডকে অনেকে পুরনো অপরাধের বিচার বলে মনে করছেন। সেই সময় থেকেই মাইকেল পাহাড়ের একাধিক উপজেলায় প্রভাব বিস্তার করে ইউপিডিএফের সশস্ত্র শাখাকে শক্তিশালী করেছিলেন।
গোপন সূত্র জানায়, তার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ সদস্যরা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর হামলা, সাধারণ ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের কাছ থেকে কোটি টাকার চাঁদা আদায় এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করত।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, ২০১৮ সালের শক্তিমান চাকমা হত্যাকাণ্ডেও তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ওই হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে ঘৃণার রূপ নিয়েছিল, তা পার্বত্য রাজনীতির ইতিহাসে এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। শক্তিমান চাকমা, যিনি ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) এর কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন, তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে পার্বত্য রাজনীতিতে সহিংসতা নতুন মাত্রা পায়। এর পর থেকেই ইউপিডিএফ দুই ভাগে বিভক্ত হয়, এবং মাইকেল চাকমা প্রসীত বিকাশ খীসার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে ইউপিডিএফ (মূল) এর প্রধান মাঠ পর্যায়ের সংগঠক হিসেবে পরিচিতি পান।
এছাড়া খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক ধর্ষণ ঘটনার পরও ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের মাঠে নামানোর পেছনে মাইকেলের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও স্থানীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে সাধারণ পাহাড়িদের উসকে দেন, যাতে আন্দোলনের নামে সহিংসতা ছড়ানো যায়। নিরাপত্তা সূত্র বলছে, ওই ঘটনায় পাহাড়ের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্টের চেষ্টা ছিল একটি পরিকল্পিত চক্রান্ত, যার পেছনে মাইকেল ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের অর্থায়ন ও দিকনির্দেশনা কাজ করেছে।
পাহাড়ের রাঙ্গামাটি, নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম শহর পর্যন্ত তার নামে একাধিক খুন, মাদক চোরাচালান, অপহরণ ও টেন্ডারবাণিজ্যের মামলা রয়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, ইউপিডিএফের সদস্যরা তার নেতৃত্বে নিয়মিতভাবে ঠিকাদারদের কাছ থেকে ৫% থেকে ১০% পর্যন্ত চাঁদা আদায় করত। যারা দিতে অস্বীকার করত, তাদের ওপর হামলা, দোকানপাট ভাঙচুর, এমনকি অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে। মাইকেলের নির্দেশে ইউপিডিএফ সদস্যরা অনেক সময় পাহাড়ি জনগণকেও জিম্মি করে রাখত, যাতে সংগঠনের অস্তিত্ব বজায় থাকে।
২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পাল্টে যায়। ইউপিডিএফের মতো সশস্ত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম কমে আসে, এবং অনেক সদস্য আত্মসমর্পণ করে সাধারণ জীবনে ফিরে আসে। কিন্তু সেই সময়েই মাইকেল চাকমা হঠাৎ প্রকাশ্যে এসে নিজেকে “নির্যাতিত নাগরিক” হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে সব মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। কিন্তু তার এই অবস্থান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এটি একটি কৌশল যার মাধ্যমে তিনি আবারও পার্বত্য রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল এলাকা, যেখানে সামান্য উসকানিও বড় ধরনের সংঘর্ষের জন্ম দিতে পারে। “সরকার যদি কঠোর অবস্থান না নেয়, তবে মাইকেল চাকমার মতো নেতাদের পুনরুত্থান পাহাড়ে সহিংসতার নতুন অধ্যায় খুলে দিতে পারে।” সাধারণ জনগণের মতে, শান্তিচুক্তির পর যেভাবে কিছু সশস্ত্র সংগঠন ধীরে ধীরে পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে, তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অশনিসঙ্কেত।
স্থানীয়রা মনে করেন, প্রশাসনের দীর্ঘদিনের উদাসীনতা, অপরাধীদের প্রশ্রয় এবং রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানিতা পাহাড়ের এই অস্থিতিশীলতার মূল কারণ। “যখন প্রশাসন ও রাজনৈতিক দলগুলো চাঁদাবাজি ও সহিংসতার বিরুদ্ধে একক অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়, তখন মাইকেলের মতো অপরাধীরা ‘রাজনীতিক’ পরিচয়ে নিরাপদ আশ্রয় পায়। এতে শুধু পাহাড় নয়, সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও প্রভাবিত হয়।”
অন্যদিকে স্থানীয় জনসংগঠনের নেতারা বলছেন, ইউপিডিএফ এখন নামেমাত্র সংগঠন তাদের সশস্ত্র ক্ষমতা আগের মতো নেই। তবে তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি এখনো কিছুটা টিকে আছে। মাইকেল চাকমার সাজা এই সংগঠনের কাঠামোতে বড় ধাক্কা দেবে বলে তারা মনে করেন। কারণ, তিনি শুধু নেতা নন, বরং ইউপিডিএফের অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তির অন্যতম চালিকা শক্তি ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে সংগঠনটির নেতৃত্ব বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং নতুন প্রজন্মের সদস্যরা বিকল্প পথ খুঁজবে।
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, মাইকেল চাকমার বিচারকে ঘিরে কিছু বিদেশি সংগঠন ও মানবাধিকার মহল আবারও “রাজনৈতিক বন্দি” ইস্যুতে প্রচারণা শুরু করেছে। এই প্রচারণা পাহাড়ের স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে যদি ইউপিডিএফের কর্মকাণ্ডকে ‘নাগরিক আন্দোলন’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, তবে তা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকি হয়ে উঠবে।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখতে হলে শুধু আইন প্রয়োগ নয়, বরং উন্নয়ন ও পুনর্বাসন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। ইউপিডিএফের মতো সংগঠনগুলো যে দারিদ্র্য ও অবহেলার সুযোগ নিয়ে জন্ম নিয়েছিল, সেই বাস্তবতাকে পরিবর্তন করাই এখন সবচেয়ে জরুরি। সরকার ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, জেলা পরিষদ ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে পাহাড়ের অবকাঠামো উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তবে সেসব প্রকল্পে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগও রয়েছে, যা দূর করা না গেলে পরিস্থিতি আবারও জটিল হতে পারে।
বর্তমান সরকার যদি মাইকেল চাকমার মতো নেতাদের বিচারের মধ্য দিয়ে যদি রাষ্ট্র একটি বার্তা দিতে পারে যে, সহিংসতা ও অপরাধ কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না, তাহলে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ আরও আত্মবিশ্বাসী হবে। তবে একইসঙ্গে তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ দিতে হবে, যাতে সন্ত্রাসীরা আর নতুন করে সদস্য সংগ্রহ করতে না পারে।
স্থানীয় আরো মনে করেন, মাইকেল চাকমার সাজা পাহাড়ে একদিকে ন্যায়বিচারের প্রতিফলন হলেও অন্যদিকে এটি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। তারা বলেন, “যদি রাজনৈতিক দলগুলো সত্যিকারের দেশ প্রেম নিয়ে কাজ করতো, তাহলে পাহাড়ে কেউ অস্ত্র তুলে নিতে পারতো না।”
সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, মাইকেল চাকমার আট বছরের সাজার রায় শুধু একটি অপরাধীর দণ্ড নয়, বরং পাহাড়ে শান্তি ও ন্যায়বিচার পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এখন প্রয়োজন রাষ্ট্রের দৃঢ়তা, প্রশাসনের জবাবদিহিতা এবং স্থানীয় জনগণের সহযোগিতা। কারণ, পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনা মানে শুধু তিন জেলার নিরাপত্তা নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা।
মাইকেল চাকমার সাজা ইউপিডিএফের জন্য এক বড় ধাক্কা, কিন্তু যদি প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দৃঢ় অবস্থান না নেয়, তবে এই শূন্যতা নতুন কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী পূরণ করতে পারে। তাই এখনই সময়, সরকারকে কঠোর নিরাপত্তা নীতি গ্রহণ করা। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ওঠিয়ে নেয়া সেনা ক্যাম্প গুলো কে যথা স্হানে পুন:স্হাপিত করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি।সেনা ক্যাম্প গুলো উঠিয়ে নেয়ার কারণে পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠী গুলোর উপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ ভার না থাকায় তারা নিজস্ব শক্তি মত্তা প্রদর্শনের সুযোগ পায়।এটা চিরতরে বন্ধ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী কে আরো জোরদার করতে হবে তা না হলে আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে বহি:শত্রুর অনুপ্রবেশ দিন দিন বাড়তে থাকবে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে যত দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্হিতি ও তত দ্রুত স্থিতিশীল পর্যায়ে চলে আসবে।
তথ্য সূত্র: Hill Documentary.