মাহবুবুর রহমান খানঃ গত ৫ এপ্রিল ছিল বাংলা সাহিত্যের দিকপাল প্রখ্যাত অনুবাদক অধ্যাপক গোলাম সামদানি কোরাইশির জন্মতিথি। যিনি বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক নির্লিপ্ত অথচ অবিস্মরণীয় সাধক। ১৯২৯ সালের ৫ এপ্রিল নেত্রকোণা জেলায় কেন্দুয়া থানা ধীন সম্ভ্রান্ত কাউরাট গ্রামে এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন গোলাম সামদানী কোরায়শী। কিন্তু তার জীবন, কর্ম ও সাধনা ছিল অসাধারণ। শৈশব থেকেই মেধা, অধ্যবসায় ও সংস্কৃতির প্রতি প্রবল টান নিয়ে এগিয়ে চলা এই মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, গবেষক, অনুবাদক এবং শিক্ষক।
গোলাম সামদানী কোরায়শীর শিক্ষা জীবন ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য। ঘাটুরকোনা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে নেত্রকোণার বিভিন্ন হাই স্কুল ও মাদ্রাসায় শিক্ষাজীবনের বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে তিনি কাৎলাসেন মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে অষ্টম স্থান অর্জন করেন। এরপর ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল এবং কামিল উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উজ্জ্বল কৃতিত্ব দেখান। বাংলার প্রতি তার টান তাঁকে নিয়ে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তিনি বাংলা অনার্স ও এম. এ. সম্পন্ন করেন সাফল্যের সাথে। এই দীর্ঘ ও নিরলস শিক্ষাযাত্রা ছিল কেবল নিজেকে গড়ার জন্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠার প্রস্তুতি।
অধ্যাপনা পেশার মধ্য দিয়ে তিনি জ্ঞান ছড়িয়েছেন নানা প্রজন্মে। নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে ১৯৬৮ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি যে আলোর পরশ বিলিয়েছেন, তা অগণিত ছাত্রছাত্রীকে প্রভাবিত করেছে। এছাড়া বাংলা একাডেমিতে কাজ করেছেন গবেষক ও পাণ্ডুলিপি সংকলক হিসেবে, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সহকারি হিসেবে। তার কর্মজীবন ছিল একাধারে সৃজনশীল ও নিরবচ্ছিন্ন সাধনাময়।
তাঁর সাহিত্যকর্মের পরিধি এতটাই বিস্তৃত যে এক নিঃশ্বাসে তা গোনা দুষ্কর। প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, ছড়া, কবিতা, অনুবাদ, জীবনী, আত্মজীবনী এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি পদচিহ্ন রাখেননি। ‘সাহিত্য ও ঐতিহ্য’, ‘পিতৃভাষা’, ‘আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ইসলাম’ কিংবা শিশুদের জন্য রচিত ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’ ও ‘ছোটদের দুদুমিয়া’ – প্রতিটি কাজেই ফুটে উঠেছে তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও মানবিক সংবেদনশীলতা।
বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তার অনুবাদকর্ম – কালিলা ও দিমনা, আল-মুকাদ্দিমা, তারিখ-ই-ফিরোজশাহী কিংবা হেজাজের সওগাত, এ সকল অনুবাদমূলক কাজের মাধ্যমে তিনি মুসলিম সভ্যতার জ্ঞানভাণ্ডারকে বাংলা ভাষায় তুলে এনেছেন, যা আমাদের সাহিত্যভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়।
তাঁর লেখনীতে ছিল একধরনের অন্তর্জগতের আলো, যা তিনি নিজের ভেতর থেকে আহরণ করে পাঠকের হৃদয়ে ছড়িয়ে দিতে পারতেন। ‘স্বর্গীয় অশ্রু’, ‘মহাপ্লাবন’, ‘চন্দ্রাতপ’, ‘পুত্রোৎসর্গ’ প্রতিটি উপন্যাস যেন তার চিন্তার এক একটি ধারা। ছোটগল্পে যেমন ‘জায়দার বাপের বেহেস্ত’ বা ‘রক্ত চোষার ফরিয়াদ’ -এ উঠে এসেছে সমাজবাস্তবতা, তেমনি শিশুতোষ রচনায় ছিল কোমলতা ও নান্দনিক ছন্দ। নাটকেও তিনি রেখেছেন সার্থক পদচারণা – ‘সাপের ছোবল’, ‘গাধার কলজে’, কিংবা ‘ক্ষুধিত সিংহাসন’ আজও প্রাসঙ্গিক।
শ্রম ও মনুষ্যত্ব সম্পর্কে তাঁর ভাবনা ছিল অত্যন্ত গভীর। এক জায়গায় তিনি লেখেন, “আমাদেরকে বুঝে শুনে পরিশ্রম করতে হবে। তবেই আমাদের পরিশ্রম সমাজ প্রগতির বাহক হয়ে আমাদের মনুষ্য জন্মকে ধন্য করবে।” এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে করেছেন এক অনন্য মানবিক বোধসম্পন্ন চিন্তক। সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি যুক্ত ছিলেন সক্রিয়ভাবে। বঙ্গবন্ধু পরিষদ থেকে শুরু করে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ময়মনসিংহ সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত সর্বত্রই ছিল তাঁর জাগ্রত উপস্থিতি। তিনি শুধু একজন লেখকই ছিলেন না, ছিলেন সংগঠক, প্রগতিশীল সমাজচিন্তার ধারক।
তার সৃষ্টিশীল অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি পেয়েছেন কুমারদী মাদ্রাসা সাহিত্য পুরস্কার, আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার এবং মৃত্যুর বহু পরে, দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা – স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৭)।
গোলাম সামদানী কোরায়শী আজ আমাদের মাঝে শারীরিকভাবে উপস্থিত নন, তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন ১৯৯১ সালের ১১ অক্টোবর। কিন্তু তার চিন্তা, চেতনা ও সাহিত্য আমাদের মাঝে থেকে যাবে চিরকাল। তিনি যেমন লিখেছিলেন, “হয়তো তার দেহে স্বাস্থ্যে চাকচিক্য নেই… কিন্তু মানুষ হিসাবে সে শ্রেষ্ঠ।” তেমনি তিনিও বাহ্যিক জৌলুস ছাড়াই ছিলেন মানুষের কাতারে শ্রেষ্ঠতম।
তাঁর ‘৯৬তম’ জন্মদিনে আমরা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি এই নির্লোভ, নিরবিচার, মেধাবী ও মানবিক মানুষটিকে, যিনি এক জীবনে যতটুকু সৃষ্টি করে গেছেন, তা শতজন্মেও অনুকরণ করা দুরূহ।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া এবং
গোলাম সামদানি কোরাইশি সম্পর্কিত বিভিন্ন ওয়েবসাইট।