শাহ আলী তৌফিক রিপন
বিশেষ প্রতিনিধি:
কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে মাত্র ২/৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী গ্রাম পিজাহাতি, যা এক সময় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য পরিচিত ছিলো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই গ্রামটি ভয়াবহ সামাজিক সংকট ও সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ও প্রতিহিংসার জটিল খেলায় আজ এই গ্রাম রীতিমতো এক সংঘর্ষের ময়দানে পরিণত হয়েছে।
বিগত ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিবর্তনের পর থেকেই পিজাহাতিতে শুরু হয় সামাজিক বিভাজনের এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়। বিশেষ করে রাস্তা নির্মাণ নিয়ে সুমন ভুইয়া ও ওয়াদুদ ভুইয়া নামক দুই প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা বিরোধ এক পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। এতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে এবং দায়ের হয় একটি হত্যা মামলা, যার প্রধান আসামী হন ওয়াদুদ ভুইয়া।
ওই মামলার আসামিরা ছয় মাস কারাভোগের পর ২৮ মার্চ ২০২৫ জামিনে মুক্তি পান। তবে গ্রামে ফিরে আসার চেষ্টায় তাদের প্রতিপক্ষের হুমকি ও বাধার মুখে পড়তে হয়। অভিযোগ রয়েছে, এখনো তারা নিজ গ্রামে ফিরতে পারেননি এবং পরিবারসহ মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এখানে উল্লেখ্য যে,জামিনপ্রাপ্তদের ফিরে আসার দুই দিনের মাথায়, ৩০ মার্চ ভোরে, ঘটে যায় আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা—একটি বসতবাড়িতে আগুন লাগে। এতে গ্রামে নতুন করে উত্তেজনার জন্ম হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মো. সুকেল মিয়া এ ঘটনায় ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামী করে কেন্দুয়া থানায় মামলা (নং:৪- তারিখ ০৭/০৪/২০২৫) দায়ের করেন। অভিযোগ অনুযায়ী, ঘরে অনধিকার প্রবেশ, চুরি, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে।
সুকেল মিয়া অভিযোগ করেন, “ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আমি একটি গরু বিক্রি করে ১,৬০,০০০ টাকা ঘরে রেখে দিই। রাতে দেখি ঘরে আগুন লেগেছে। আগুন নেভাতে গিয়ে ওয়াদুদ ভুইয়া ও তার লোকজনকে পালাতে দেখি। তারা বল্লম ছুঁড়ে মারার চেষ্টা করে।”
অন্যদিকে ওয়াদুদ ভুইয়ার ছোট ভাই ছোটন ভুইয়া পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, “আমরা ছয় মাস জেল খেটে জামিনে ফিরলেও গ্রামে ঢুকতেই পারি নাই। আমাদের শত শত কাঠা জমি পড়ে আছে, চাষ করতে দেওয়া হচ্ছে না। ওই আগুন তাদের নিজেরাই লাগিয়ে আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়েছে।”
পিজাহাতি গ্রামের সাধারণ মানুষ এখন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ প্রকাশ্যে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গার্মেন্টস কর্মী বলেন, “বিরোধ তো আগেই ছিলো, কিন্তু আগুন কারা লাগিয়েছে জানি না। শুধু আতঙ্ক নিয়েই থাকি।”
কেন্দুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি মিজানুর রহমান বলেন – বসতঘরে আগুন দেয়ার অভিযোগে থানায় মামলা রুজু হয়েছে এবং অভিযোগের আলোকে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যাবস্থা নেয়া হচ্ছে।
গ্রামের এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রশাসনের সুস্পষ্ট ও নিরপেক্ষ পদক্ষেপ খুবই জরুরি। বিশ্লেষকদের মতে, বিচারিক প্রক্রিয়াকে আদালতের হাতে ছেড়ে দিয়ে সামাজিক প্রতিশোধ পরিহার করাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। একসাথে বসে সংলাপ, গ্রাম্য সালিশ বা মধ্যস্থতা ছাড়াও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সক্রিয় ভূমিকাও প্রয়োজন।
শান্তিপূর্ণ পিজাহাতি আজ আগুনে পুড়ছে—শুধু ঘর নয়, পুড়ছে সম্পর্ক, বিশ্বাস আর সামাজিক সংহতি। এখনই সময় সমঝোতা, সহাবস্থান ও আইনের শাসনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার। প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সচেতন সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের পথ খোলা সম্ভব নয়।