ক্রাইম রিপোর্টার:( দৈনিক জনতার দেশ)
সাম্প্রতিক সময়ে নরসিংদী ডিসি অফিসের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলাম গ্রেফতারের পর থেকে আতংকে আছেন অন্যান্য জুনিয়র ম্যাজিস্ট্রেটগণ। এমসিসিতে স্বাক্ষরকে কেন্দ্র করে গত ১৪ জুলাই ভোররাতে ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুলকে ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে আটক করা হয়। নরসিংদী ডিসি অফিসের আরেকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সাজ্জাদ পারভেজ ১৮ ও ১৯ জুলাই এমসিসিতে নিজ স্বাক্ষরে ও হাতে লিখে গুলিবর্ষণের আদেশ দিলেও প্রশাসন তাকে নিয়ে নীরব। মোঃ সাজ্জাদ পারভেজ স্বাক্ষরিত এমসিসি দুইটি বর্তমানে ভাইরাল। এ নিয়ে নরসিংদী জেলার জুলাই আন্দোলনে শহীদ পরিবার ও আহতদের মাঝে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ম্যাজিস্ট্রেট সাজ্জাদ বহাল তবিয়তে নরসিংদীতে অবস্থান করছে। বিভাগীয় কমিশনার অফিসে তার একটি বদলি অর্ডার হলেও তা এখনও কার্যকর হচ্ছে না বলে জানা গেছে।
এদিকে নরসিংদীতে চাকরিকালীন তার একাধিক অপকর্মের তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। জানা যায়, জুডিশিয়াল মুন্সিখানা শাখার দায়িত্বে থাকাকালীন ব্যাপক অপকর্মের সাথে লিপ্ত ছিলেন এই কর্মকর্তা। ড্রাইভিং লাইসেন্স সংক্রান্ত কাজে নরসিংদী বিআরটিএ-তে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনে প্রচুর আর্থিক অনিয়মের সাথে জড়িত হবার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ কাজে তাকে সহায়তা করতো সাদ্দাম হোসেন নামে এক যুবক। সকল অপকর্মে তার সহায়ক এই সাদ্দামকে দিয়ে অবৈধ অর্থ উপার্জন করতো সাজ্জাদ। জানা যায় গত বছর নভেম্বর মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নরসিংদী জেলার সমন্বয়ক মুনিয়া রহমান মনিকার পিতা মানিককে বিআরটিএর দালাল সাজিয়ে সাদ্দাম ও আনসার বাহিনীকে দিয়ে পেটায় সাজ্জাদ। পরবর্তীতে সাজ্জাদ নিজের অপকর্ম ঢাকতে জেলা প্রশাসনের দৈনিক মজুরিতে চুক্তিভিত্তিক ড্রাইভার সুবেলকে ফাঁসিয়ে দেয়, এতে চাকরি হারায় সুবেল। তবে সাদ্দামের চাকরি গেলেও সাজ্জাদের সহযোগী হিসেবে গোপনে সে কাজ করতে থাকে। এছাড়া বন্দুকের লাইসেন্সের জন্য মোটা অর্থ না দিলে ফাইল উপরে প্রেরণ করতেন না তিনি।
এদিকে তার অত্যাচারে অতিষ্ট ছিল জেএম শাখার কর্মচারীগণও। তিনটি আবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর তারিখে জে,এম শাখার অফিস সহকারি কাম কম্পিউটার অপারেটর মোঃ সিরাজুল ইসলাম, উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসমাউল খান, অফিস সহায়ক মোঃ হারিছুল হক একযোগে তিনটি পৃথক আবেদনে তাদের বদলির জন্য মানবিক আবেদন করেন জেলা প্রশাসক বরাবর। আবেদনে সিরাজুল ও আসমাউল ব্যক্তিগত কারণ উল্লেখ করলেও অফিস সহায়ক হারিছুল আবেদনে উল্লেখ করেন, জে,এম শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক বিভিন্ন সময় দুর্ব্যবহার, অসদাচরণ ও বিভিন্ন সময় গালমন্দ করেছে, যা একজন সামান্য চাকরিজীবী হলেও তার আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে। দীর্ঘ ২৮ বছর চাকুরিজীবনে এমন আচরণ কোন কর্মকর্তা তার সাথে করেনি বলেও জানান হারিছুল। তিনজনের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঠিক সে সময় জে,এম শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন সাজ্জাদ পারভেজ। অন্যান্য শাখায় কর্মচারীদের কাছে এই তিনজনের প্রত্যেকে তাদের ভুক্তভোগী হবার কথা জানিয়েছে এমন কর্মকর্তার আচার-ব্যবহার অত্যন্ত নিম্নমানের। জে,এম শাখায় মোবাইল কোর্টের বিল করার সময় অফিস সহায়ক ও পেশকারের সম্মানি থেকেও সাজ্জাদ পারভেজ ভাগ নিতো বলে জানা গেছে।
এসব অপরাধের কথা আমলে নিয়ে জেলা প্রশাসক অর্ডার করে তাকে জেএম শাখা থেকে সরিয়ে দেন জানুয়ারি মাসে। এর পর সে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। একজন ম্যাজিস্ট্রেট লিখিত অর্ডারের শিডিউল অনুযায়ী মাসে চারদিনের বেশি মোবাইল কোর্ট করার কথা না থাকলেও সাজ্জাদ পারভেজের মোবাইল কোর্ট পরিচালনার গতিবিধি ও ডিসিআর বইয়ের সিরিয়াল ঘেটে দেখা গেছে গড়ে প্রতি মাসে সে পঁচিশদিন বা আরও বেশি মোবাইল কোর্ট করে সে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ অমান্য করে বিভিন্ন জায়গায় মোবাইল কোর্ট করেছেন তিনি। যদিও জরিমানার ডিসিআর কপি একজন মোবাইল কোর্টে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে দেওয়ার কথা, সাজ্জাদ পারভেজ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডিসিআরের কপি দিতো না। এতে করে ডিসিআর বইয়ে কম টাকা লিখে আদায় করা অতিরিক্ত টাকা লুটপাট করে এসেছে দীর্ঘদিন ধরে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবসের দিন নিরপরাধ ছেলেমেয়েদের আটকে টাকা নেওয়া ও একাধিক মেয়েকে দিয়ে ছেলেদের চর-থাপ্পর দেওয়াতো এই স্যাডিস্ট সাজ্জাদ। এমনকি বিগত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের দিনেও মোবাইল কোর্ট স্টিকার লাগানো গাড়িতে ফোর্স নিয়ে সে মোবাইল কোর্ট করতে বের হয় সে। খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায় গত ২ বছর যাবত বিভিন্ন ধরনের দোকানপাটে তার বনিবনা না হলে জুনিয়র ম্যাজিস্ট্রেট প্রেরণ করে মোবাইল কোর্ট করাতো সে। সার্কিট হাউজের সম্মুখের মোল্লা স্টোরে খোঁজ নিয়ে এর সত্যতা পাওয়া যায়। এছাড়া অযথা বেশি করে জরিমানা ও জেল দিয়ে নিজেকে জাহির করতো এই সাজ্জাদ। তার সাথে বিভিন্ন সময়ে মোবাইল কোর্ট করা পেশকাররা এই তথ্য জানায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নরসিংদীর ডিসি অফিসের একজন কর্মচারী জানান, সাজ্জাদ পারভেজ কখনই অফিসবান্ধব কর্মকর্তা ছিল না। অফিসের সুনাম বিনষ্টের জন্য যাবতীয় কর্মকাণ্ড করে এসেছে সে। সে ৪০তম প্রশাসন সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক হবার পর থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে গেছে। এখন আমরা চাই তাকে দ্রুত অপসারণ করা হোক।
অপরদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার দাবি, গুলিবর্ষণের আদেশদানকারী এই কর্মকর্তাকে দ্রুত গ্রেফতার করা হোক ও আইনের আওতায় আনা হোক।
নরসিংদী জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, কর্মচারীগণের মাঝে এ মুহূর্তে সাজ্জাদ পারভেজের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাকে দ্রুত বিদায় করা না হলে কঠোর কর্মসূচীতে যাবেন তারা।আওয়ামীলীগ সরকারের এজেণ্ডা
বাস্তবায়নে নরসিংদীতে হেন কাজ নেই যা সাজ্জাদ করেনি।