শাহ আলী তৌফিক রিপন, বিশেষ প্রতিনিধি :
কেন্দুয়া, ২২ জানুয়ারি ২০২৫: ঐতিহ্যবাহী কেন্দুয়া প্রেসক্লাবের উদ্যোগে শুরু হওয়া শিল্প ও পণ্য মেলা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। মেলার আড়ালে লটারি বাণিজ্য পরিচালনার অভিযোগে স্থানীয় জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। মেলার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে, যার ফলে সাধারণ মানুষ আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মেলার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা পেশাদার মেলা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম প্রেসক্লাবের সাথে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে মেলা পরিচালনার দায়িত্ব নেন। মেলার প্রবেশ টিকিট গেইটে বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও, রফিক সি এন জি অটোর মাধ্যমে উপজেলায় ফেরি করে টিকিট বিক্রি শুরু করেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল লটারির আড়ালে একটি জুয়ার আয়োজন, যা প্রথমে প্রেসক্লাব বুঝতে না পারায় প্রতারণার ফাঁদে পড়ে।
কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদার জানান, “পরিচ্ছন্ন একটি মেলার মাধ্যমে স্থানীয় শিল্পের প্রসার ঘটার প্রত্যাশা থেকে মেলাটির অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে জনপর্যায়ে লটারির নামে জুয়ার অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এবং বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংগঠন লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ করলে আমি কয়েকবার লটারি বন্ধ করে দিই। কিন্তু আমার আদেশ উপেক্ষা করে তারা কিছুদিন বন্ধ রেখে পুনরায় লটারি চালু করে।”
ইমদাদুল হক তালুকদার আরও বলেন, “বিষয়টি বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নজরে আনলে তিনি আমাকে মেলাটি বন্ধের নির্দেশ দেন। এছাড়াও, বিভিন্ন ভুক্তভোগীরা রফিকের বিরুদ্ধে প্রতারণার লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। রফিক পৌর কর ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। একজন ভুক্তভোগীর জিডির ভিত্তিতে সদর থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করলে, আমি থানায় গিয়ে সকল পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, অফিসার ইনচার্জ ও সার্কেল এএসপি মহোদয়ের সাথে প্রতারিতদের সম্মুখে রফিককে মুখোমুখি করি এবং বিষয়টির সুরাহার চেষ্টা করি। সকলের উপস্থিতিতে রফিক দেনা-পাওনা মেটানোর প্রতিশ্রুতি দেন এবং কিছু বকেয়া পৌর কর পরিশোধ করে লিখিত মুচলেকা দিয়ে মুক্ত হন। তবে মুক্তির পর থেকে রফিক প্রশাসন, প্রেসক্লাব ও ভুক্তভোগীদের হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।”
কেন্দুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন – রফিকের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও হুমকি প্রদানের অভিযোগ দেয় মেলা মাঠের জমির মালিক। পাশাপাশি সে পৌর কর পরিশোধ না করে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয়ের দিকনির্দেশনায় তাকে আটক করা হয় এবং পরবর্তীতে পাওনা পরিশোধ করার নিমিত্তে মুচলেকায় মুক্তি দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলার প্রক্রিয়া চলমান।
স্থানীয় সচেতন সমাজ মেলার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুতি ও জুয়ার প্রচলনের প্রতিবাদ জানায়। এর ফলে রফিককে লটারি বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়। তবে তিনি পুনরায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় লটারি চালু করেন এবং পুরো উপজেলায় লটারি জুয়ার উৎসব ছড়িয়ে পড়ে। কোটি টাকার টিকিট বিক্রি হয়, এবং সাধারণ মানুষ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে।
অবশেষে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে মেলার সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং মেলার আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রশাসনের অধীনে চলে যায়। ইমদা্দুল হক তালুকদার আরও জানান, “আমি ও অফিসার ইনচার্জ স্বশরীরে উপস্থিত থেকে ভুক্তভোগীদের সকল জব্দকৃত পণ্য নিরাপদে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করি। পৌর কর আদায়ের জন্য পৌরসভা সার্টিফিকেট মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের প্রতারকচক্রের হাতে দেশের শিল্প ও সংস্কৃতি বেহাত হয়ে গেলে এটি আমাদের জাতীয় লজ্জার বিষয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতারণা রোধে আমাদের সকলকে সতর্ক হতে হবে।”
মেলায় অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। সারোয়ার জাহান নামক একজন ডেকোরেটার্স ব্যবসায়ী বলেন, “রফিক প্রতিদিন আমাকে ৬,০০০ টাকা ভাড়া দেওয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু এখনো ২ লাখ টাকার উপরে পাওনা রয়েছি।” টুটন নামক আরেক ব্যবসায়ী জানান, “রফিক লটারিতে পুরস্কার হিসেবে মোটরসাইকেল দেওয়ার নাম করে আমার কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নিয়েছে।”
এ ঘটনায় স্থানীয় জনগণ প্রেসক্লাবের অসাবধানতাকে দায়ী করে এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতারণা বন্ধে প্রশাসনের আরও কঠোর তদারকির দাবি জানায়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড রোধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।