বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৩৭ টি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। অসুস্থ ও চিকিৎসাধীন দলীয় চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াও তিনটি আসনে প্রার্থী হয়েছেন।আর দলটির ভার প্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বগুড়ার ৬ আসন থেকে। এখন প্রশ্ন ওঠেছে দলটির নির্বাচনী প্রচারে নেতৃত্ব দেবেন কে? আর প্রধানমন্ত্রী হবেন কে? বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচনা- সমালোচনার ঝড় তুঙ্গে।কারণ খালেদা জিয়া এখনো পুরোপুরি সুস্থ্য নন। আর তারেক জিয়া কবে দেশে ফিরছেন তা এখনো চূড়ান্ত করতে পারেননি তার দলটি। যদিও দলটি বলছে তিনি শিগগিরই দেশে ফিরবেন।কবে কখন তাও নিশ্চিত বলতে পারছেন না দলের শীর্ষ মহল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন খালেদা জিয়াকে তিনটি আসনে প্রার্থী হিসেবে রাখা দলটির একটি নির্বাচনী কৌশল। তাদের ধারণা নির্বাচনে জিতে বিএনপি জিতে গেলে তারা সরকার গঠন করবে এবং তারেক রহমান নেতৃত্ব দেবেন। আবার কেউ কেউ বলছেন তারেক রহমান দেশে না ফেরা পর্যন্ত তার ফেরা নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে এবং সে কারণেই বিএনপি নেতৃত্বের জায়গায় খালেদা জিয়াকেই শীর্ষ স্হানে রেখেছেন তিনটি আসনে প্রার্থী করার মধ্য দিয়ে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহম্মদ বলেছেন, আমরা আশা করি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে দলের নেতৃত্ব দেবেন এবং নির্বাচনে মাঠে ময়দানে নেতৃত্ব দেবেন তারেক রহমান। আর বর্তমান বাস্তবতায় তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হবেন এটাই আমাদের চিন্তা। বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয় থাকা তারেক রহমান ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। বিএনপি’র ঘোষণা অনুযায়ী খালেদা জিয়া নির্বাচন করবেন ফেনী-১ বগুড়া- ৭ এবং দিনাজপুর – ৩আসন থেকে। অন্যদিকে তারেক রহমান বগুড়া ৬ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেবেন। খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রথম অংশ নিয়েছিলেন ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে। কিন্তু তার বড় ছেলে তারেক রহমান এবার ই প্রথম নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। যদিও ২০০৮ সালের ২২ শে জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন,কিন্তু সেই নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হয়নি। আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হওয়ার পর বিএনপি’র পক্ষ থেকে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। মূলত এরপর থেকে দলীয় কার্যক্রম তাকে ঘিরে পরিচালিত হচ্ছে। আবার এসব কর্মকাণ্ড লন্ডন থেকে পরিচালনা করে আসছিলেন স্বয়ং তারেক জিয়া। এর আগে ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট বিশাল জয় নিয়ে সরকারে আসার পর তারেক রহমানকে দলের যুগ্ম মহাসচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অনেকে মনে করেন সেই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে খালেদা জিয়া কার্যত তারেক রহমানকে দলের ভবিষ্যত নেতা হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেছিলেন। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন এ নিয়ে রাজনৈতিক সংঘাতের মুখে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর চরম সংকটে পড়েছিল এই রাজনৈতিক দলটি। ওই বছরের ৭ মার্চ গ্রেফতার করা হয়েছিল তারেক রহমানকে। খালেদা জিয়াও গ্রেপ্তার হয়ে ছিলেন। ১৮ মাস কারাগারে থাকার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তারেক রহমানকে মুক্তি দেওয়া হয়। তিনি তখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন এর আগে ১৩ টি মামলায় জামিন পান তারেক রহমান। এরপর ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন তিনি।লন্ডন যাত্রার আগে তার মা খালেদা জিয়া গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন সুস্হ্য না হয়ে ওঠা পর্যন্ত তারেক রহমান রাজনীতির বাইরে থাকবেন। তবে ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথমবারের মতো স্বীকার করেন যে, ২০১২ সালে তারেক রহমান বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিলেন এবং এক বছরের মধ্যেই সেটি গৃহীত হয়েছে। এর মধ্যেই লন্ডন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তারেক রহমান। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড হলে দলীয় সর্বময় ক্ষমতা আর নেতৃত্ব তার হাতেই ওঠে আসে। দলটির সভা সমাবেশে গত কয়েক বছর ধরে নেতাকর্মীদের কাছে তারেক রহমানকেই মূখ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এরপর তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডন গেলে ৭ বছর পর তার সঙ্গে তারেক রহমানের সাক্ষাৎ হয়।বর্তমানে দলটির সার্বিক কর্মকান্ড তারেক রহমানের নেতৃত্বেই পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি লন্ডনে তার সঙ্গে বৈঠকের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনুস ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে দলটির একাধিক নেতা বলেছেন খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নেবেন কী,না তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেক। কারণ, তিনি অনেকদিন ধরে হাসপাতালে বা বাসায় চিকিৎসাধীন আছেন। এসব কারণে নেতাদের ধারণা ছিল প্রতিকী হিসেবে খালেদা জিয়া হয়তো একটি আসনে থাকবেন আর মূল নেতা হিসেবে তারেক রহমানই হয়তো একাধিক আসনে নির্বাচন করবেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিএনপি এই বার্তাই দিয়েছে যে খালেদা জিয়া এখনো সক্রিয় আছেন, তিনিই এখনো দলটির শীর্ষ নেতা। তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয় খালেদা জিয়াকে প্রার্থী করে আনাটা হল দলটির নির্বাচনী কৌশলের একটি অংশ। নির্বাচন নিয়ে যে সকল প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে সে বিষয়ে একটা বার্তা আপাতত পৌঁছে গেছে সে বিষয়ে আর কোন অনিশ্চয়তা নেই। আর খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ভাবমূর্তি কাজে লাগানোর কৌশল তো আছেই। তার মতে তারেক রহমান এখনো দেশে না আসায় তার ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা বা উদ্বেগ এখনো কাটেনি। লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ ও বলেছেন, এই অনিশ্চয়তার কারণেই হয়তো তিনটি আসনে খালেদা জিয়াকে প্রার্থী করে বিএনপি বুঝাতে চেয়েছে যে, তিনি এখনো বিএনপির দলনেতা। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচন ও সরকারের কে নেতৃত্ব দেবেন তা এখনো পরিষ্কার না। এমনও হতে পারে যে, খালেদা জিয়া দলনেতা হিসেবে থাকবেন আর দলটি সরকার গঠন করলে তাতে নেতৃত্ব দিবেন তারেক রহমান। তবে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদের কথায় একটা কিছু পরিষ্কার হয়েছে যে,তারা বিজয়ী হলে তারেক রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিবেন এই চিন্তাই দলের মধ্যে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। যদিও এ সব কিছুই স্পষ্ট হবে তারেক রহমান দেশে ফিরে আসার পর। তবে তিনি কবে ফিরছেন তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তারিখ এখনো তার দল জানাতে পারেনি।আর তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন না করলে দলীয় নেতা কর্মীদের মধ্যে একটা বড় ধরনের ফ্যাসাদ বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে,দলের চেইন-অব কমাণ্ড ভেঙ্গে পড়বে,যা সামাল দেয়া কারো কারো পক্ষে সম্ভব হবেনা। যা দলের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে এমনটিই জানালেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
তথ্য সূত্র: * বিবিসি বাংলা* ঢাকা মেইল পোস্ট *