আবদুল মোকতাদির মামুনঃ
মেজর আবদুল গণি,যিনি টাইগার গণি নামে বেশ পরিচিত ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। তার জন্ম ১৯১৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর,ব্রিটিশ-ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ত্রিপুরা (বর্তমান কুমিল্লা) জেলার বুড়িচং থানার (বর্তমান ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা) নাগাইশ গ্রামে। তিনি প্রথমে কুমিল্লা এবং পরে কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪০ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪১ সালে ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল।
সেনাবাহিনীতে তিনি লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন লাভ করেন এবং বার্মা (মিয়ানমার) সেক্টরের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। তার সাহসিকতার জন্য তাকে “টাইগার গণি” উপাধি দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তিনি ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি পান। আবদুল গণি “ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট” এর প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর “বেঙ্গল রেজিমেন্ট” হিসেবে পরিচিত এবং সবচেয়ে বড় পদাতিক রেজিমেন্ট।
ব্রিটিশ শাসন থেকে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির পর ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠিত হয়। ক্যাপ্টেন গণি বাঙালিদের নিয়ে রেজিমেন্ট গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সিনিয়র ব্রিটিশ ও বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর ব্রিটিশ জেনারেল মেসারভি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। আগে থেকেই তিনি ক্যাপ্টেন গণিকে চিনতেন এবং মহাযুদ্ধে বাঙালি সৈনিক,অফিসার ও ক্যাপ্টেন গণির বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
সে সুবাদে তিনি জেনারেল স্যার মেসারভিকে বাঙালিদের নিয়ে একটি রেজিমেন্ট গঠনের অনুরোধ জানিয়ে পত্র লেখেন। মেসারভি এ প্রস্তাব অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করেন। ঢাকায় আসার পর বাঙালি রেজিমেন্ট গঠন করার জন্য ক্যাপ্টেন গণি জোর তৎপরতা শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ক্যাপ্টেন গণিকে বাঙালি রেজিমেন্ট গড়ার বিষয়ে আশ্বাস প্রদান করেন। ক্যাপ্টেন গণি উপযুক্ত জনবল নিয়োগের জন্য সারা পূর্ব পাকিস্তান ঘুরে বেড়াতে থাকেন। কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন সঠিক ব্যক্তিকে রিক্রুট করার জন্য,যাতে পাকিস্তানের সব রেজিমেন্টের মধ্যে বাঙালি রেজিমেন্টের সৈনিকরা হয় সেরা। ঢাকার কুর্মিটোলায় এসব সৈনিকের কঠোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
ক্যাপ্টেন গণি ও অন্য অফিসারদের আপ্রাণ চেষ্টায় মাত্র পাঁচ মাসে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনের সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে ব্রিটিশ সেনা অফিসার লে. কর্নেল ভি জে ই প্যাটারসনকে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এবং রেজিমেন্টের জ্যেষ্ঠ বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী সদ্যোজাত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ সংস্থা বা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক/কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কুর্মিটোলা সেনানিবাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল,যা “সিনিয়র টাইগার” নামে পরিচিত। তৎকালীন পাকিস্তানের ইতিহাসে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বর্ণাঢ্য এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রদেশের গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক ব্রাবোর্ন, মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন,মন্ত্রী নবাব হাবীবুল্লাহ, হাসান আলী,নুরুল আমিন,এস এম আফজাল, হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী,আবদুল হামিদ,সামরিক বাহিনীর উপ-আঞ্চলিক অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান (পরে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি) উচ্চপদস্থ সব সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা। পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের পর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পতাকা উত্তোলন করেন গভর্নর ফ্রেডারিক ব্রাবোর্ন। ১৯৫৪ সালে মেজর গণি (টাইগার গণি) সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন।
মেজর আবদুল গণি ১৯৫৭ সালের ১১ নভেম্বর পশ্চিম জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে মারা যান। কুমিল্লা সেনানিবাসে তাকে দাফন করা হয়েছে। আমার জানা নেই,কুমিল্লায় জন্ম গ্রহণকারী এ মহানায়কের নামে কুমিল্লা মহানগরীতে কোনো সড়ক কিংবা স্মৃতিফলক আছে কি না। না থাকলে টাইগার গণির স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য কিছু করা অত্যন্ত জরুরি।
সূত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ